Blog

ফ্রিম্যাসন

আমি প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণের একটা টাইটেল দিয়েছিলাম- in search of American soul.

তাই আমেরিকান ভু- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাইতে বেশি ঘুরেছি ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে। সে বার ১১টা স্টেট ঘোরার বৃত্তান্ত লিখলে একটা ডাউস ভ্রমণ কাহিনী হবে নিঃসন্দেহে ।

আমেরিকার দাসদের জীবন নিয়ে লেখা এলেক্স হ্যালির অমর গ্রন্থ দ্যা রুটস আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে গিয়ে দেখেছি সেই সব জায়গা যেখানে আফ্রিকান দাস গ্যাব্রিয়েল প্রসের ১৮০০ সালে বিদ্রোহ করে ধরা পরেছিল, পরে তার ভাই সহ আরও ২৫ জন দাস কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় দাস বিদ্রোহ হয় ১৮৩১ সালে, যার নায়ক ছিল ন্যাট র্টানার। জেমস নদীর উপর ব্রিজের পাটাতনে লিখা আছে মর্মস্পর্শী সেই সব দাস বিদ্রোহের শোকগাঁথা। গিয়েছি এই ভার্জিনিয়ার উইলিয়ামবার্গ আর জেমস টাউনে, যেখানে ব্রিটিশরা প্রথম তাদের কলোনি প্রতিষ্ঠা করেছিলো।

বর্ণবাদ বিরোধী অহিংস আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত আটলান্টায় গিয়েছি কালো মানুষদের নেতা মার্টিন লুথার কিং এর জন্মস্থান আর জাদুঘর দেখতে।

I have a dream বলে যিনি আমেরিকাকে সাম্যের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই মার্টিন লুথার কিং আর মহাত্মা গান্ধী কে এক ফ্রেমে দেখে অবাক হয়েছিলাম।

আরও অবাক হয়েছি মাত্র ৬০/৭০ বছর আগে এই আমেরিকার মাটিতে কালো মানুষেরা সাদাদের সাথে এক বাসে উঠতে পারতো না, আর কালো মানুষেরা নিজেদের অধিকারের জন্য প্লাকার্ডে I am a Man লিখে রাস্তায় মিছিলে নামত, সেই প্লাকার্ডটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠেছিলো, বোঝাতে পারব না।

পেনসিলভেনিয়াতে খুঁজে খুঁজে গিয়েছি আমেরিকান সিভিল ওয়ারের ব্যাটেল গ্রাউণ্ডগুলোতে।

গিয়েছি গেটিসবার্গের সেই জায়গায় যেখানে আব্রাহাম লিঙ্কন তার বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন- Government of the People, by the people, for the people shall not perish from the earth.

আমি ক্রিস্টফার কলাম্বাসের মত চোখ দিয়ে আমেরিকা কে বুঝতে আর আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলাম।


আজ ফেসবুক আমাকে মনে করিয়ে দিল, ২০১৭ সালে আজকের দিনে আমি পেনসিলভেনিয়ার ভ্যালি ফোরজের ন্যাশনাল হিস্টরিক্যাল পার্কে গিয়েছিলাম, যেখানে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সর্বাধিনায়ক জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন তার ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে শীতকালীন ঘাটি তৈরি করেছিলেন। তখন প্রতিপক্ষ ব্রিটিশ বাহিনী ১৮মাইল দুরের রাজধানী শহর ফিলাডেলফিয়া দখল করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আজ ভ্যালি ফোরজের ব্যাটেল গ্রাউণ্ডের ছবি দেখতে দেখতে এক জায়গায় আটকে গেলাম, যেটা আমাকে তখনই চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ভ্যালি ফোরজের সারে তিন হাজার একরের বিশাল শ্বাসরুদ্ধকর সবুজ প্রান্তরের অনেক ঐতিহাসিক মনুমেন্টের ভিতরে একটি মনুমেন্ট সদম্ভে ঘোষণা করছে যে- জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন হলেন একজন ‘ফ্রিম্যাসন’।


তখন অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, কাদের হাতে তৈরি হয়েছে এই আমেরিকা। আর কি লক্ষ্য নিয়েই বা তারা আমেরিকাকে নির্মাণ করেছে !!!

ফ্রিম্যাসন কি? আর এরা কারা?

এই ফ্রিম্যাসনদের আধুনিক নাম ইলুমিনাতি।

ফ্রিম্যাসন হল বিশ্বের প্রাচীনতম গুপ্ত সংঘ যারা শয়তানের উপাসনা করে । যে গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের জেরুজালেমের টেম্পল অভ সলোমন-এর রাজমিস্ত্রি বা ম্যাসনদের ভিতর। যে গোষ্ঠীটির সঙ্গে জড়িত মধ্যযুগের ক্রসেডার, কুখ্যাত নাইট টেম্পলারদের বিভিন্ন শয়তানী কর্মকান্ড। যে গোষ্ঠী বাগদাদ ও কর্ডোভা হতে চুরিকৃত জ্ঞান দিয়ে ষোড়শ শতকের ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির যুগ বা ‘এজ অভ এনলাইটমেন্ট’ ঘটিয়েছে। এরাই সপ্তদশ শতকের ‘ম্যাসনিক গিল্ড’ বা ‘রাজমিস্ত্রিদের সংঘ’। এই গোষ্ঠীই সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং সমাজবিপ্লবের পিছনে সক্রিয় ছিল। বলা হয় মূলত ইহুদীরাই ফ্রিম্যাসনের মাস্টার মাইন্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অদৃশ্য নিয়ন্তা যে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীটি- সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ছিল ফরাসি লেখক ভলতেয়ার, জার্মান সঙ্গীতবিদ মোজার্ট, মার্কিন বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিজীবী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে বর্তমান কালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও জর্জ বুশ।

কন্সপেরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, শক্তিমান সিক্রেট সোসাইটি ইলুমিনাতি মূলত এ বিশ্বের সকল প্রধান ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে।
ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের সূচনাও ইলুমিনাতির হাতেই। এরা নেপোলিয়নের ওয়াটারলু যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে । এরা শয়তানের উপাসনার মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করে। খ্রিস্টান তত্ত্বমতে, ইলুমিনাতির এক চোখা প্রতীক হল বাইবেল মতে ৬৬৬ বা যাকে বলা হয় অ্যান্টিক্রাইস্ট। আর মুসলিম মতে, রাসুল সাল্লেলাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যৎবানী অনুযায়ী একচোখা দাজ্জাল ।

ড্যান ব্রাউনের নভেল এঞ্জেল্‌স অ্যান্ড ডেমন্‌স প্রকাশের পরে এই সংগঠনটি আধুনিক কালে আবার আলোচনায় আসে।
এদের প্রতীক হল জ্যামিতির ত্রিকোণ আর পরিমাপের স্কেল, যার কেন্দ্রে আছে “জি” ।

২০০৭ সালে, আমি তখন লন্ডনে।
হলর্বন স্টেশনে নেমে গ্রেট কুইন স্ট্রিট ধরে হাঁটছিলাম। একটা দুর্গের মত বিশাল ভবনের সামনে রাখা বোর্ডের উপর লেখাটা চোখে পড়েছিল হঠাৎ করেই। সেখানে লেখা ছিল – উইনষ্টন চার্চিল একজন ফ্রিম্যাসন।

ঘটনা কি বুঝার জন্য ভালমত তাকিয়ে দেখি আমি দাড়িয়ে আছি গুপ্ত সংঘ ফ্রিম্যাসনের জাদুঘরের সামনে। কেউ চাইলে ঘুরে আসতে পারে, লন্ডনের হলর্বন আর কভেন্ট গার্ডেন স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায়, (ঠিকানা- 60 Great Queen St, Holborn, London WC2B 5AZ, UK)।

একটু পরই একদল ক্যানাডিয়ান টুরিষ্ঠের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে অদ্ভুত এক অনুভুতি হয়েছিলো আমার। কেন যেন বারবার একটা শিরশিরে অনুভুতিতে আমার গায়ের পশম দাড়িয়ে যাচ্ছিলো। কেমন একটা পুরানা গন্ধ আর ভৌতিক আবহ। বিশাল পুরাতন ভবনের অনেক ভিতরে আলো আধারি ঘেরা একটা সন্মেলন কেন্দ্র আছে। তার বিশাল দেয়াল জুড়ে আঁকা একটা চোখের ছবি।

যেমনটা আছে আমেরিকান এক ডলারের গায়ে। এক ডলারে নোটে একটা পিরামিডের ছবি আছে। পিরামিডের নিচে লেখা Novus ordo seclorum- মানে হল new world order বা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় পৃথিবীর নেতৃত্ব থাকবে আমেরিকার হাতে। আর সেই আমেরিকাকে চালাবে জায়ানিষ্ট ঈসরাইল। স্বার্থপর ‘এক চোখা’ ভোগবাদী পুঁজিবাদী প্রফিট ছাড়া আর কিছু বুঝে না। গত পঞ্চাশ বছরের পৃথিবী দেখেছে আমেরিকার একচোখা পররাষ্ট্রনীতি। যার মাধ্যমে মূলত শক্তিশালী হয়েছে ইসরাইল।

আমরা যে সাত জন আমেরিকান ফাউন্ডিং ফাদারের নাম জানি যেমন জন এডামস, বেনজামিন ফাঙ্কলিন, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, জন জেয়, থমাস জেফারসন, জেমস মেডিসন এবং জর্জ ওয়াশিংটন, এরা আসলে কারা ছিল? আর এদের উদ্দেশ্যই বা কি ছিল? কোন গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে তারা আমেরিকা তৈরি করেছে?

এই সব প্রশ্ন বারবার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, আর আমি
ভ্যালি ফোরজের সেই ফ্রিম্যাসন মনুমেন্টের ঘোষণা বারবার পড়তে থাকি।
তবে কি আমেরিকা পৃথিবীর জন্য ভালো কিছুই করে নি?

কন্সপ্রেসি থিউরি র মতো করে এর উত্তর আছে-
একটা খারাপ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ৯৯টা ভালো কাজ কর।

Related posts