Blog News

ব্যান্ডের সাথে নেশার সম্পর্ক কি

গীতিকবির নাম বিভ্রাট, ইচ্ছাকৃত না ষড়যন্ত্র


নৈরাশ্যবাদী শিল্পীরা পৃথিবীকে নৈরাশ্য ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। যদিও কখনো কখনো নৈরাশ্য থেকেও সৃষ্টি হয়ে থাকে মহৎ শিল্প, তথাপি শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতা এবং হতাশা দারুণভাবে প্রভাবিত করে তার অনুরাগীদের। শিল্পী অথবা শিল্প যদি অনুরাগীদের জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে তবে সেই শিল্পী অথবা শিল্পকে মহৎ বলা যায় কিনা এ ব্যাপারে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু সঙ্গীতের কিংবদন্তী জ্যামাইকার বব মার্লে যখন গঞ্জিকা সেবনের অধিকারের জন্য সোচ্চার হন এবং তাতে যখন এই বঙ্গবাসী একজন তরুণ গঞ্জিকা সেবনে উৎসাহিত হয়ে ওঠে তখন ব্যাপারটা মর্মপীড়ার কারণ হয়। জীবনে কিছুই না পেয়ে হতাশা এক জিনিস আর সব কিছু বেশি বেশি পেয়ে হতাশা অন্য জিনিস। পাশ্চাত্যের চরম ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থার বলি নির্ভানার কার্ট কোবেইনের আত্মহত্যা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। পৃথিবীব্যাপী নির্ভানার লক্ষ লক্ষ ভক্তদের খবর না জানলেও আমার এই শহরের এমন অনেক তরুণকে আমি জানি যারা কোবেইনের ড্রাগ আসক্তিতে প্রভাবিত হয়ে নিজেরাও ভেসে গেছে ড্রাগে। ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকার বিপদগ্রস্ত বিপর্যস্ত তারুণ্যের মুখপাত্র হয়ে যার আবির্ভাব সেই জিম মরিসনের উশৃঙ্খল লাইফ স্টাইলে প্রভাবিত হয়ে কত তরুণ যে নেশায় আসক্ত হয়েছে তা মরিসনের অসংখ্য ভক্ত আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। আজ পৃথিবীব্যাপী ব্যান্ড মিউজিকের যে জয়জয়কার তার সাথে জড়িয়ে গেছে এক বিশাল মাফিয়া নেটওয়ার্ক। ইউরোপ, আমেরিকার কনসার্টগুলিতে টিকিট বিক্রির চাইতে দ্বিগুণ টাকা মাফিয়ারা আয় করে ড্রাগ বিক্রি করে। এল.এস.ডি, কোকেন, ডোপ, হেরোইন ইত্যাদি ড্রাগগুলো ফেরিওয়ালাদের হাতে চকলেট বিক্রির মত করে কনসার্টে বিক্রি হয়। এমন অনেক ব্যান্ড আছে যাদের গানের রস আস্বাদনের জন্য ড্রাগ গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। ড্রাগ গ্রহণের মাধ্যমে সেই সমস্ত ব্যান্ডের গান শোনা এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ব্যান্ডের গানের চিত্তচাঞ্চল্যকর গতি সুপার ইলেকট্রনিক্স ইন্সট্রুমেন্টের উত্তেজক পারফরমেন্সের সঙ্গে বৈচিত্রধর্মী লিরিকের সংমিশ্রণে পারফরমারদের মাদকতাপূর্ণ উপস্থাপন একজন তরুণ শ্রোতাকে এমনিতেই আপ্লুত করে রাখে, তার উপরে যদি গানের কথায় বা প্রিয় গায়কের উপস্থাপনে ফুটে ওঠে ঢুলুঢুলু নেশার আবহ তবে তাতে যদি সেই তরুণের ভেতরে ড্রাগ গ্রহণের মত অ্যাডভেঞ্চার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তবে তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। প্রচন্ড ব্যক্তি স্বাধীনতায় অভ্যস্ত ইউরোপ আমেরিকার তরুণদের হয়তো এসব মানায়। কিন্তু আমাদের মত সমাজে তা মেনে নেয়া কঠিন।

পাশ্চাত্য হচ্ছে আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃৎ। এ দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠাতা সবাই পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গত তিন দশকের অবিরাম সাধনার ফলশ্রুতিতে সঙ্গীতের এই আধুনিক মাধ্যমটি এদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সাধুবাদ জানাই তাদেরকে। ওদের কল্যাণেই আমাদের বাংলাগান বিশ্ব তারুণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে। তাছাড়া হিন্দি গানের এই প্রবল জোয়ারে একমাত্র ব্যান্ড সঙ্গীতই বাংলা গানের উল্লেখযোগ্য বাজার টিকিয়ে রেখেছে।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে চন্দ্রের আলোকিত পৃষ্ঠের অপর পিঠেই যেমন রয়েছে অন্ধকার ক্ষত, তেমনি আধুনিকতার স্রোতে অবধারিতভাবে প্রয়োজনীয় সুন্দরের পাশাপাশি ভেসে আসা অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত কদর্যতা যেন আমাদের তারুণ্যের সর্বনাশ না ঘটায়।

ব্যক্তিগতভাবে ব্যান্ড সঙ্গীতের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা একজন গীতিকবি হিসেবে। আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় অনুধাবন করেছি যে, আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের নির্মল সজীব উদ্দামতার সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে “বিষ”। তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমাদের এখানে “ব্যান্ড সঙ্গীত” এই দোষে অভিযুক্ত নয়, আমি অভিযুক্ত করছি “ব্যান্ড শিল্পীদের।

পাশ্চাত্যের ডোরস, ডিপ-পারপল, বিটলস, পিংক ফ্লয়েড, রেলিং স্টোন, মেটালিকা, বব মার্লে এন্ড ওয়েলস, নির্ভানা, ডায়ার স্ট্রেইটস, মেগাডেথ, স্করপিয়ন্স, ড্রিম থিয়েটার, স্যানটানা প্রভৃতি ব্যান্ডের কোন কোন পারফরমারদের উচ্ছৃঙ্খল লাইফস্টাইল অনুকরণে নিজের ইমেজ সৃষ্টি করতে গিয়ে আমাদের কিছু ব্যান্ড তারকাও মাদকাসক্তির দোষে অভিযুক্ত হয়েছেন। বর্তমান জীবনের প্রতি সচেতনভাবে উদাসীন এবং নিজেকে দুঃসাহসীর মত নিঃশেষ করার এই মেকি হতাশার খোলসে তাদের ড্রাগে আসক্তি সস্তা এবং বাতিল ষাট দশকের রোমান্টিসিজম ছাড়া আর কিছুই নয়। একথা অবধারিত সত্য যে, আমাদের কোন কোন জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা এবং স্টাইলের দ্বারা প্রভাবিত অনেক তরুণ আসক্ত হয়েছে নেশায়। প্রিয় তারকার ড্রাগ আসক্তি উৎসাহিত করছে একজন তরুণকে ড্রাগের প্রতি। প্রচলিত আছে যে “গাঞ্জা বা ডাইল ছাড়া ‘অমুক ব্যান্ডে’র কনসার্ট ভাবাই যায় না।” এমন মানসিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে তরুণদের একটা অংশ। আর হবেইবা না কেন, জমজমাট কনসার্টে তার প্রিয় তারকাকে টলতে টলতে জড়ানো স্বপ্নময় গলায় যখন সে গান গাইতে দেখে তখন তার ভিতরে ড্রাগ গ্রহণের ইচ্ছা জাগতেই পারে। ইদানীং কনসার্টগুলোতে গঞ্জিকা ধুম্র উদগীরনের ব্যাপকতা আমাকে শঙ্কিত করেছে। আমার প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এই রচনাটির অবতারণা। ব্যান্ডসঙ্গীতের ভক্ত শ্রোতারা প্রিয় তারকার অধ্যবসায় ও সৃজনশীলতা অনুসরণ করুন, বর্জন করুন তার ব্যক্তিগত নিষিদ্ধ উচ্ছৃঙ্খলতা। মনে রাখবেন আপনার প্রিয় তারকা তার নিজের জীবন এবং ক্যারিয়ার নিয়ে যথেষ্ট সচেতন, আপনি কেন শুধু শুধু খানিক মোহের বশে নিজের সর্বনাশ করবেন। আর ব্যান্ড তারকাদেরও মনে রাখা উচিত, যে ড্রাগ বিরোধী প্রচারধর্মী পারফর্মেন্স এবং সুশৃঙ্খল নীতিবোধ সম্পন্ন লাইফস্টাইল নিজের ভক্তদের মাঝে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

১৬ জুন ১৯৯৭
আনন্দভুবন

Related posts